ধরুন, আপনি এক লেখকের খোঁজে বেরিয়েছেন। তিনি জীবিত অবস্থায় ছিলেন নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ, নিজের লেখাকে নিজেই ঘৃণা করতেন। তিনি বলে গেছেন—“আমার মৃত্যু হলে, আমার সব লেখা আগুনে পুড়িয়ে ফেলো!”। কিন্তু সেই লেখাগুলোই একদিন পৃথিবী কাঁপাবে—পাঠক কাঁদবে, ঘুম হারাবে, আর এই লেখকের নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে।
এই মানুষটি ছিলেন—ফ্রানৎস কাফকা, একজন যিনি নিজেই ছিলেন এক জীবন্ত রহস্য।
গোপন লেখক, লুকিয়ে রাখা সাহিত্য
১৮৮৩ সালে চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ শহরে জন্ম নেন কাফকা, এক ইহুদি পরিবারে। বাইরে থেকে তিনি ছিলেন এক সাদামাটা অফিসকর্মী, দিনে কাজ, রাতে নীরবে লেখালেখি। তার ডেস্কের এক গোপন ড্রয়ারে জমছিল ভয়ংকর, অদ্ভুত, এবং মনস্তাত্ত্বিক গল্প।
তিনি জানতেন, এই লেখা প্রকাশ হলে লোকে হাসবে, ঘৃণা করবে। তাই তিনি তার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে বলেছিলেন—
“আমার মৃত্যু হলে সব লেখা পুড়িয়ে ফেলো। কোনো কিছু প্রকাশ করবে না।”
কিন্তু ভাগ্য ছিল অন্য রকম। ম্যাক্স তার কথা রাখলেন না।
তিনি সেই লেখাগুলো প্রকাশ করলেন, আর বিশ্বসাহিত্য পেল এক অদ্ভুত জগত—’Kafkaesque’ নামে পরিচিত।
Kafkaesque মানে কী? এক ভয়াবহ বাস্তবতা
Kafkaesque মানে? এমন এক দুনিয়া, যেখানে আপনি নিজেও জানেন না কেন আপনি এখানে। আপনি অপরাধী কিনা জানেন না, বিচার হচ্ছে কিনা জানেন না, অথচ চারদিক থেকে যেন শ্বাসরোধকারী নিয়ম আপনাকে গ্রাস করছে।
এই জগতে সবকিছু অলীক, কিন্তু অস্বস্তিকরভাবে বাস্তব। কল্পনার মাটিতে দাঁড়িয়ে Kafka দেখিয়েছেন, বাস্তব জীবনের দুঃস্বপ্ন কতটা নিস্তারহীন হতে পারে।
দ্য ট্রায়াল: এক অপরাধহীন অপরাধীর গল্প
এক সকালে ঘুম ভেঙে দেখলেন—আপনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু আপনার অপরাধ কী, কেউ জানে না। আপনাকে বলা হচ্ছে—চিন্তা করবেন না, বিচার হবে। কিন্তু কখন? কোথায়? কেউ বলে না।
এই ছিল কাফকার বিখ্যাত উপন্যাস “The Trial”-এর কাহিনি।
নায়ক জোসেফ কে. দিন দিন পাগল হয়ে যায়, সে ভাবে, “আমার তো কিছুই হয়নি, তবুও কেন আমার পেছনে সবাই লেগে আছে?”
এই গল্প পড়ে যেন আমরাও নিজের জীবনের এক অনিশ্চিত ট্রায়ালে পড়ে যাই। চাকরি, সমাজ, সম্পর্ক—সবকিছু যেন জোসেফ কে.-র মতো আমাদের দমিয়ে ধরে, আর আমরা জানি না মুক্তির রাস্তা কোন দিকে।
দ্য মেটামরফোসিস: ঘুম ভাঙলে আপনি পোকা!
ভাবুন, এক সকালে উঠে দেখলেন, আপনি আর মানুষ নন—এক বিশাল পোকা!
এটাই ঘটেছিল কাফকার “The Metamorphosis”-এ। গ্রেগর সামসা নামের এক সাধারন তরুণ এক সকালে জেগে দেখেন তিনি এক বিভৎস পোকায় রূপান্তরিত। প্রথমে পরিবার আতঙ্কিত, পরে ঘৃণা, তারপর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া।
অবশেষে… তার বাবার ছোঁড়া এক আপেলে মৃত্যু।
কাফকা নিজেই বলেছিলেন, “আমি পিতার হাতে আহত সন্তান।” এই গল্প ছিল তার নিজের জীবনের এক প্রতিচ্ছবি, এক রূপক ভয়াবহতা, যেখানে পরিবারই একদিন পরিচিত পিশাচে রূপ নেয়।
মৃত্যু ও অনন্ত জীবনের খেলা
১৯২৪ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে কাফকা মারা যান। মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন দরিদ্র, নিঃসঙ্গ, ও সম্পূর্ণ অচেনা।
কিন্তু মৃত্যুর পর কী ঘটল?
বিশ্ব চমকে গেল!
একজন মৃত লেখকের অসমাপ্ত লেখাগুলো পড়ে মানুষ ঘুম হারাল, কেঁদে ফেলল, আত্মদর্শনে গেল। কাফকা যেন মৃত্যুর পর ফিরে এলেন—আরও শক্তিশালী হয়ে।

কেন কাফকা আজও আমাদের তাড়া করে?
এই ২১ শতকে আমরা এখন সিসিটিভি, ফেসবুক, কোর্ট, চাকরি, রাজনৈতিক জটিলতা ও নিয়মের জালে আটকা পড়া মানুষ। আমাদেরও জানা নেই, আমরা অপরাধী কিনা। আমাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে, নাকি আমরা শুধু এক বিশাল সিস্টেমের পুতুল?
Kafka আজও আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি।
একদা হাঙ্গেরির দার্শনিক লুকাচ গ্রেপ্তার হয়ে বুঝেছিলেন—Kafka যা লিখেছিলেন, তা ছিল ভবিষ্যতের অদ্ভুত সত্য।
শেষ কথা: আমরা সবাই Kafkaর গল্পে আটকে আছি
Kafka একবার বলেছিলেন, “আমি এক খাঁচা, যে একটি পাখির খোঁজে রয়েছে।”
আজ আমাদের চারপাশের জীবনও যেন সেই খাঁচা—যেখানে আমরা সব সময় মুক্তির খোঁজ করি, অথচ প্রতিদিন আরও জটিল বাস্তবতার জালে জড়িয়ে পড়ি।
Kafka ছিলেন ভয়, লজ্জা, ও অস্তিত্বের অন্ধকারের কবি, যিনি মৃত্যুর পরেও আমাদের সাহিত্যে, চিন্তায়, ও বাস্তবতায় জীবিত থেকেছেন—আর থাকবেন চিরকাল।