১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষের আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও, আমাদের সামনে আজ এক অমোঘ প্রশ্ন – আমরা কি সত্যিই স্বাধীন? আমরা কি কেবল ভৌগোলিকভাবে স্বাধীন, নাকি মানসিকভাবে এবং রাষ্ট্রের কাঠামোর দিক থেকেও মুক্ত হতে পেরেছি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা কিছু বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রোপাগান্ডার ফাঁদে আটকে থাকা এক জনগণ
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতার পর থেকে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে রেখেছে। তারা জনগণকে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে শাসিত করেছে, যেন তারা সহজেই নিয়ন্ত্রিত থাকে। মানুষের চিন্তা, মতামত এবং স্বাধীন বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং গণমাধ্যমের মধ্যে যে মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটার কথা ছিল, তা হয়নি। পরিবর্তে, আমাদের শেখানো হয়েছে কেবল একপেশে ইতিহাস আর নেতা বন্দনার কৌশল। সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি শেখানোর পরিবর্তে, আমাদের শেখানো হয়েছে কেবল কাগজে কলমে লেখা মুখস্থ করা। ফলাফল – শাসকেরা যাতে কখনো প্রশ্নের মুখে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা।
“কে কম খারাপ?” – জনগণের বদ্ধমূল মানসিকতা
আজকের বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই সীমিত। আমরা ভোটের সময়ে বা কোনো ইস্যুতে কেবল একটি প্রশ্নে আটকে যাই – কে কম খারাপ? এক দলকে চোর মনে হলে, অন্য দলকে তুলনামূলকভাবে “কম চোর” হিসেবে মেনে নিই। একদল স্বৈরাচারী হলে, আরেকদলকে “তুলনামূলক ভালো” বলে মেনে নিই। কিন্তু এর মধ্যে আমরা ভুলে যাই, রাজনীতির আসল লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ, রাষ্ট্রের সুশাসন আর ন্যায়বিচার।
জনগণের অধিকার ভুলে যাওয়া
আজ আমরা ক’জনই-বা জানি যে রাষ্ট্রের প্রকৃত কাঠামো কেমন হওয়া উচিত? রাষ্ট্রীয় নীতিমালা কেমন হলে নাগরিকের কল্যাণ নিশ্চিত হবে? মানুষের মৌলিক অধিকার – স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাকস্বাধীনতা – এই বিষয়গুলো আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে নেই। আমরা রাষ্ট্রের কাঠামো বা শাসনব্যবস্থা নিয়ে ভাবি না। কারণ আমাদের শিখানো হয়নি এই বিষয়গুলো। শিখানো হয়েছে নেতা বন্দনা। শিখানো হয়েছে কেবল ভক্তি আর আনুগত্য – সমালোচনা নয়।
বিভক্তির রাজনীতি: জনগণের ঐক্য ভাঙার খেলা
একটি দেশ তখনই এগিয়ে যায়, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে চায় না। বরং তারা জনগণকে বিভক্ত করে রাখে – ভাষা, ধর্ম, অঞ্চল, গোষ্ঠীভিত্তিক বিভাজন তৈরি করে। কারণ বিভক্ত জনগণ শাসকদের পক্ষে সুবিধাজনক। তারা ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে পারে। জনগণ পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে আসল ইস্যুগুলো – দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান – সবকিছু ভুলে যায়। আর এই সুযোগে রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে যায়।
আমাদের করণীয়: নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা
যদি সত্যিই আমরা স্বাধীনতার মানে উপলব্ধি করতে চাই, তাহলে আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে হবে। নেতা বন্দনার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে নেতা-জনগণের মধ্যে জবাবদিহিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা মুখস্থবিদ্যা নয়, যুক্তির মাধ্যমে নতুন চিন্তা করতে শেখে। যাতে তারা শাসকদের প্রশ্ন করতে শেখে, ভয়ে নয়, বরং দেশের মঙ্গলের জন্য। আমাদের গণমাধ্যমে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের হাতে সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা নয়, সত্যিকারের জনমত গড়ে তোলার কাজ করতে হবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই ৫০ বছরে আমরা অনেক কিছু অর্জন করেছি – অর্থনীতি, প্রযুক্তি, অবকাঠামো। কিন্তু মানসিকভাবে আর রাষ্ট্রের কাঠামোর দিক থেকে আমরা এখনো পূর্ণ স্বাধীন হতে পারিনি। সুতরাং, আমাদের উচিত এখন একটাই – প্রশ্ন করা। নিজেরা জানার চেষ্টা করা। অন্যায় আর শাসকের সীমাহীন ক্ষমতা মেনে না নেওয়া। কারণ, জনগণই হলো একটি দেশের প্রকৃত মালিক। যদি আমরা নিজেরা সজাগ না হই, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা কেবলই একদিনের উল্লাসে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।